সমস্ত লেখাগুলি

চিনে রাখা প্রয়োজন -
সায়ন কর্মকার
Nov. 18, 2024 | যুক্তিবাদ | views:819 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আজ একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের বিজ্ঞান দুর্বার গতি লাভ করেছে। অভূতপূর্ব তার উন্নতি। আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানকে এবং বিজ্ঞানের দৌলতে পাওয়া কৃতকৌশল প্রযুক্তিবিদ্যাকে জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহার করেও আমরা অনেকেই বিজ্ঞান বিরোধী। তবু আজ জনমনে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অলৌকিকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে চাইছে। বিজ্ঞান বিরোধিতার স্থূল ও সূক্ষ্ম চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ডারউইন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা-র বই, প্রবন্ধ লক্ষ লক্ষ বিক্রি হয়েছে। পরমাণু জগৎ থেকে মহাকাশবিদ্যা, এমনকি মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা বৃদ্ধির ব্যাপক চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ অলৌকিক শক্তির প্রতি নিরর্থক প্রার্থনা ছেড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আরাধনায় রত হয়েছে। তবু কেন মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ছে না? 

        এমন হওয়ার কারণটি আমাদেরই সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর হুজুর দল ও তার মদত পুষ্ট ধান্দাবাজ গোষ্ঠীর ধর্মীয় নেতা, জ্যোতিষী-তান্ত্রিক-বাবাজি-মাতাজি, প্যারাসাইকোলজিস্ট-রা কখনোই চায় না সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার আলো প্রবেশ করুক। তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সাধারণ মানুষদের ডুবিয়ে রাখে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের সুগভীর সাগরে, টিকিয়ে রাখে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজটাকে।

সম্প্রতি এক ভূত গবেষিকা ঈশিতা দাস সান্যাল ও তার দল "ডিটেকটিভ অফ সুপারন্যাচারাল (DOS)”উদয় হয়েছে যারা বিভিন্ন বিতর্কিত অঞ্চল গুলোতে (তথাকথিত ভৌতিক, অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা) সত্যানুসন্ধানের নামে একটা অলৌকিক আবরণে আবৃত পরিবেশ গড়ে তোলে এবং তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ব্যাখ্যা ও ভয়ের সঞ্চার করে। বছর খানেক আগেও এই ঈশিতা দাস সান্যালকে 'দাদাগিরি'-র মতো একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি(?) শো তে এসেও অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা ভূতুরে গুলগপ্পের চচ্চড়ি রান্না করতে দেখা গিয়েছিল। ঈশিতা দাস সান্যাল ও তাঁর দলের মতো আরো অনেক ভূত অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন বিজ্ঞানবিরোধী ধ্যান-ধারণা সঞ্চার করে চলেছে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কে। বলা ভালো প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে। এই সকল প্যারাসাইকোলজিস্ট রা স্বভাবে ধুরন্ধর চালাক প্রকৃতির। তাঁরা নিজে থেকে তো বলবে না যে, আমরা মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাই! খুব চালাকির সাথে নিজেদের অবস্থানটা তৈরি করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে তারা বিজ্ঞানের পক্ষে। বলবে, আমরা জানতে চাই কী আছে? যেন এমন একটা ভাব যে – অজানাকে জানার ভীষণ চেষ্টা। তাঁরা এমন কিছু যুক্তি সামনে নিয়ে আসে যেগুলো উপর থেকে দেখলে মনে হয় ভীষণ ধারালো যুক্তি। তাঁরা উপস্থাপন করেন — বিজ্ঞানে আজও প্রমাণিত হয়নি বলে ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? —এর  সাপেক্ষে বলতে পারি যে ঘোড়ার ডিম আজও প্রমাণিত হয়নি বলে, ভবিষ্যতেও যে প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? আবার এও শোনা যায়, "বিজ্ঞান আজও প্রমাণ করতে পারেনি যে ভূত, অলৌকিকতা নেই"। এর সাপেক্ষেও বলা যায় – হাঁসজারু, বকচ্ছপ, রামগরু ইত্যাদি আজও বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি যে এগুলো নেই। এই সকল যুক্তি দিয়ে যা খুশির অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়। আসলে এগুলো কোন যুক্তিই নয়। এগুলোকে বলা হয় লজিক্যাল ফ্যালাসি বা প্রতারণা মূলক যুক্তি।


প্যারাসাইকোলজিস্টদের তথাকথিত ভূত গবেষণার কাজে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেগুলোর সাহায্যে তাঁরা ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার অস্তিত্বের প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি গুলি ব্যবহার ক্ষেত্র বিজ্ঞানে। Electromagnetic field detector, External thermometer,  Parabolic Thermometer এই সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এগুলোর সাথে ভূত, আত্মা, অলৌকিক কোনও কিছুর অস্তিত্ব খোঁজার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। প্যারাসাইকোলজিস্ট ও জ্যোতিষীরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যায় অবৈজ্ঞানিক  প্যারাসাইকোলজি ও জ্যোতিষকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করতে। Extra -sensory perception (ESP) বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (Telepathy/দূরচিন্তা, Precognition/ ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, Clairvoyance/অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, Psycho-Kines (PK)/ জড় পদার্থে মানসিক শক্তি প্রয়োগ) -র মতো চমকদার অবান্তর বিষয়গুলির সাথে কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষা চয়ন করে আর উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে প্যারাসাইকোলজিস্টরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। তাঁরা বিজ্ঞানের মোড়কে বাঁধা এক রসালো অতিরঞ্জিত সাজানো গল্প মানুষের সামনে পরিবেশন করেন। আর তার সাথে মদত দেয় মেরুদণ্ডহীন সেলিব্রিটি ও তাবড় তাবড় মানুষেরা। যার ফলে সাধারণ মানুষ সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ফলে একটা কুপ্রভাব সমাজে বিস্তার করে। লজিক ছেড়ে ম্যাজিকে চালিত হয় মানুষ। সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষ ভালোবাসে অতিরঞ্জিত গল্প গুলো বিশ্বাস করতে, তার মধ্যে ডুবে থাকতে এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার লোভও সামলাতে পারে না। যার ফলে একটা গণ হিস্টিরিয়া তৈরি হয়। বিজ্ঞানের যুগেও মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মানুষদের সাথে প্রতারণা চালিয়ে এভাবেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছে প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় এখনো ডাইনি সন্দেহে হত্যা, ভূতে ভর এই সকল ঘটনা গুলি পরিলক্ষিত হয়। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যান এবং ঘটনাগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে মানুষের ভুল ধারণার অবসান ঘটানোর চেষ্টা চালান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই সকল বিজ্ঞানবিরোধী ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার ধারণা মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে   প্যারাসাইকোলজিস্টরা ডাইনি সন্দেহ, ভূতে ভরের মতো কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস গুলিকে পরোক্ষ ভাবে মদত দিচ্ছে। এদের চিনে রাখা প্রয়োজন। 

 এ সমাজ ব্যবস্থা ততটাই এগোয় যতটা মানুষ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি বিজ্ঞানমনস্কতা। মানুষ যতদিন না অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে মুক্তমনে বিজ্ঞানের পথে না চলবে ততদিন অগ্রগতির চাকা স্তদ্ধ রয়ে যাবে। প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা এ সমাজের শত্রু। তারা সমাজের অগ্রগতির চাকাকে বিপরীতে ঘোরাতে চাইছে।

আমরা, বিজ্ঞান প্রিয় তরুণ, দেখিয়ে দিতে চাই কারা সমাজের শত্রু, প্রকৃত দেশদ্রোহী ও দেশপ্রেমিককে। 

এই পরিস্থিতিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটা কথা খুব মনে পড়ে যায় — 

তখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ

উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি

এ যদি সমাজ হয়

তবে আমি সমাজবিরোধী।

চলো,এগিয়ে চলি -
সায়ন কর্মকার
Nov. 9, 2024 | যুক্তিবাদ | views:302 | likes:26 | share: 1 | comments:0

আমাদের সমাজব্যবস্থার মূল উপাদান হল মানুষ। আবার এই সমাজে মানুষ বৈচিত্র্যময়। আজ পর্যন্ত সভ্যতা যে এতদূর এগিয়ে এসেছে, সমাজ পাল্টেছে তা পুরোটাই যুক্তির উপর নির্ভর করে। সময় এগোচ্ছে, তার সাথে সাথে আমাদেরও উচিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা, সঠিক মূল্যবোধকে গ্রহণ করা। আর সেই অগ্রগতির ধারা হবে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারাকে ধারণ করে। আবেগে গা ভাসানো চলার স্রোতের প্রতিকূলে চিন্তাভাবনা করা কিছু মস্তিস্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাই আমাদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলে। গুটিকতক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাকে যখন আমরা, সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চায় তখন নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতা হয় যুগ যুগ ধরে আমাদের মস্তিষ্ক কোষে বাসা বেঁধে থাকা 'ধর্ম' নামক এক আফিমের নেশা, সামাজিক পরিবেশ, ভয়, লজ্জা ... ইত্যাদি ইত্যাদি। 

            যে সবকিছু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের আদর্শ ও মূল্যবোধে অবিচল থেকে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগে সফল হয়ে ওঠে একমাত্র সেই সাময়িক ভাবে সেই পরিস্থিতিতে সামাজিক পরিবেশের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলেও, ইতিহাসের পাতায় সে নায়ক রূপে বিদ্যমান থাকে। 

   সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগের এক গল্প আমি বলব। বলব আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। বলব 'ধর্ম' নামক এক নেশার ঘোর কাটিয়ে মরণোত্তর দেহদানের মধ্য দিয়ে এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ কৃতিত্বের গল্প।  

      

সাল ২০১৫, ৩০ ডিসেম্বর। 

তখন প্রায় দুপুর ২ টো। আমার ঠাকুমা, লীলাবতী কর্মকার নিজ বাড়িতে বয়সজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

         আমাদের পরিবার আগে থেকেই যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আদলে সংগঠিত। যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্দ্ধে আমাদের পরিবারের সদস্য। আমার বাবা, সঞ্জিৎ কর্মকার-এর হাত ধরেই আমাদের পরিবারে বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাপেক্ষে আমরা নাস্তিক হলেও, আমরা "মানবতাবাদী"। 

এই রকম একটি পারিবারিক পটভূমিকায় ঠাকুমার মৃত্যুর পর কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা ছিল আদর্শ, মূল্যবোধ থেকে সরে আসা, যা ছিল আমাদের পক্ষে লজ্জাজনক। আদর্শ ও নীতিবোধের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ঠাকুমার মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ মেডিকেল কলেজে দান (Donate) করা হবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই এবং ঠাকুমার ইচ্ছাতেই। 

        তবে সেদিন (৩০ ডিসেম্বর) আমাদের চিন্তাভাবনার বাস্তবিক প্রয়োগের পরীক্ষায় সফল হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। 

        যেহেতু ঠাকুমা বাড়িতে মারা গেছেন সেহেতু স্থানীয় হাসপাতাল থেকে থেকে ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। আবার অন্যদিকে মৃত্যু প্রমাণপত্র না পেলে মেডিকেল কলেজও বডি গ্রহণ করবে না। এই অবস্থায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় হাসপাতালের বি.এম.ও.এইচ., ড. দেবেশ নাথ। তাঁর পরামর্শে আমরা কালীগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে মৃত্যু শংসাপত্র প্রদানের দাবি জানাই। প্রধানের অনুপস্থিতিতে আমাদের উপপ্রধানের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। তিনি বলেন মৃতদেহ আগে দাহ করা হবে, তারপর মৃত্যু প্রমাণপত্র দেওয়া হবে, তার আগে নয়। শুরুতেই একটি ধাক্কা, তার উপর আমাদের পরিবার তথা আমাদের এলাকা থেকে প্রথম এমন একটি সমাজকল্যাণ মূলক কাজের জন্য একটি মাত্র কাগজের জোগাড় করার উপায় না পাওয়ায় পরিবারের মুখে এক অসহায়তার ছাপ ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায়, যোগাযোগ করা হয় যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে। প্রবীর দা বাবাকে বলেন, "তোমাকে ডেথ সার্টিফিকেট যে কোন প্রকারে জোগাড় করতেই হবে। সহজ রাস্তায় যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন লড়াই করো। লড়াই করে আদায় করতে হবে। " প্রবীর দা-র কথায় সাহস জুগিয়েছিল বাবাকে। এরপর বি. এম. ও. এইচ. ড. দেবেশ নাথ মারফৎ বি. ডি. ও. কে সব কিছু জানানো হয়। বি. ডি. ও.-র  সহযোগিতায় তখন গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মৃত্যু প্রমাণপত্র দিতে বাধ্য হয়। 


    তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইতিমধ্যে গোবড়াপোতা থেকে "শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান" নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উপস্থিত হয়, যেখানে ঠাকুমার চক্ষুদান করা হয়। অবশেষে মৃত্যু প্রমাণপত্র হাতে আসার পর শবদেহ নিয়ে রওনা হয়, কল্যাণীর "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" এর উদ্দেশ্যে। মেডিকেল কলেজে যখন মৃতদেহ নিয়ে হাজির, তখন সকাল। কোন সিনিয়র ডক্টর, প্রফেসর ছিলেন না। দেখা হয়েছিল এক জুনিয়র ডাক্তারের সাথে। তিনি মৃতদেহ পুরোপুরি ভাবে গ্রহণের কথা দিতে না পেরে বডি মেডিকেল কলেজে রেখেই, তিন দিন পর, ৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ তে আবার মেডিকেল কলেজে আসার কথা বলেন। যথারীতি যাওয়া হয় আবার। এবার সিনিয়র ডাক্তারকে দেখানো হয় মৃত্যু প্রমাণপত্র। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র সন্তুষ্ট করতে পারেনি ডাক্তারকে। সিনিয়র ডক্টর জানালেন কোন রেজিস্ট্রিকৃত ডাক্তার কর্তৃক অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্রই গ্রহণযোগ্য হবে এবং তখন বডি গ্রহণ করা হবে। কোন উপায় না দেখে, আমাদের গ্রামের এক প্র্যাকটিসিং হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, সুকদেব দত্ত- এর অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র নিয়ে আবার হাজির হতে হয় মেডিকেল কলেজে। এরপরও সেই সিনিয়র ডাক্তার হোমিওপ্যাথি-র অজুহাত দেখিয়ে মৃতদেহ গ্রহণ করতে নাকচ করে এবং মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেই সময় তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা। এই অবস্থায় ওই সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আমাদের বি. এম. ও. এইচ. এর ফোনে কথা বলানো হয়। শেষপর্যন্ত ঠাকুমার মৃতদেহ "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" স্বসম্মানে পুরোপুরি ভাবে গ্রহণ করে। 

      শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান মারফৎ কর্ণিয়া প্রদান করা হয় "প্রভা আই ব্যাঙ্ক" এ। সেদিন এক নৈতিক যুদ্ধ জয়লাভের স্বাদ গ্রহণ করেছিল আমাদের পরিবার। জয়ী হয়েছিল আমাদের আদর্শ। এক সাধারণ পরিবার, অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল সেদিন গ্রামবাসী তথা এই সমাজের কাছে। তাছাড়া আমাদের পরিবার কোন প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ- শান্তি অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি ভাবে বর্জন করেছিল। একজন যখন সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক কল্যাণমূলক কাজ করে তখন তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা হবেই জনমানসে। ঠাকুমার মরণোত্তর দেহদানের পর গ্রামবাসী দের মধ্যে এক বিস্তর সময় ধরে আলোচনা, সমালোচনা চলেছিল। অনেক মানুষের কাছে এক অভাবনীয় সাফল্য মনে হয়েছে,  আবার কিছু মানুষের কাছে ধর্মের আচার নস্যাৎ হওয়ায়  ভয়ে কুৎসাও রটিয়েছিল। যদিও কুৎসা রটানো লোকেদের বক্তব্য সেভাবে কারোর কাছে গুরুত্ব লাভ করেনি। 

সাল ২০১৯, ২০ জুলাই। 

আমার বড়ো জেঠু (বাবার বড়দা) , সনাতন কর্মকার প্রাণত্যাগ করেন। জেঠুর আগে থেকেই শারীরিক কিছু সমস্যা ছিল। রাত তখন ১০ টা হবে। জেঠুর শারীরিক অবস্থা শোচনীয় দেখে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। 

ঠাকুমার মতোই জেঠুর ও দেহদান করা হয়। জেঠুর সদিচ্ছাতেই করা হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে ঠাকুমার মতো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। হাসপাতালেই মারা যাওয়ার ফলে হাসপাতাল থেকেই মৃত্যু প্রমাণপত্র পাওয়া যায়।  কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা চক্ষুদান করতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও ওইসময় যোগাযোগ করা যায়নি চক্ষুদানের জন্য।  পরদিন জেঠুর মৃতদেহ দান করা হয় "মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে"। 


আমাদের পরিবার থেকে পরপর দুটি সফল মরণোত্তর দেহদানে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এক খুড়তুতো ঠাকুমারও চক্ষুদান করা হয়। ২০১৯ সালে ২৪ ডিসেম্বর আমার খুড়তুতো ঠাকুমা, দীপালি কর্মকার নিজ বাড়িতেই প্রাণত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে পূর্বে দেহদানের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শুধু চক্ষুদান করা হয়। এই কাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধু মঞ্জু কর্মকার। 

এই ঘটনাটি আমাদের পারিবারিক নয়। আমাদের এক সহযোদ্ধা, বাবার বন্ধু, শিবুরাম মন্ডল-এর লড়াই। তিনিও চেয়েছিলেন ধর্মের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে। 

সাল ২০২০,  ১০ অক্টোবর । 

রাত্রে নিজ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিবুরাম মন্ডল-এর মা, বীণা মন্ডল। গ্রামের এক ডাক্তার, সুদেব দাক্ষীৎ এর থেকে ডেথ সার্টিফিকেটও পাওয়া যায়। 

তবে COVID–19 এর মহামারীর প্রকোপে কোন মেডিকেল কলেজই শবদেহ গ্রহণ করেনি। চক্ষুদানও করা যায়নি। 

       এই পরিস্থিতিতে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুরে, গোরাবাজার শশ্মানে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ করা হয়। যেহেতু আমরা আত্মার অস্তিত্বকেই পুরোপুরি ভাবে নস্যাৎ করেছি, তাই সেক্ষেত্রে আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ শান্তি করাটাও বোকামির পরিচয়। সেকারণে মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে পুরোপুরিভাবে বর্জন করেছেন শিবুরাম মন্ডল। যদিও নিজে আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে শ্রাদ্ধ শান্তি থেকে বিরত থাকলেও নিজের ভাই বা দিদির ধর্মীয় কাজকর্মে কোন প্রকার বাধা দেননি। নিজের আদর্শ ও নীতিবোধের প্রতি অবিচল থেকেছেন শিবুরাম মন্ডল। 

  তবে গ্রামবাসীদের দাবি ছিল – শিবুরাম মন্ডল কেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টাও করা হয় শিবুরাম মন্ডল এর উপর। কিন্তু শিবুরাম মন্ডলের পাশে ছিল তার বাবা, নিত্যানন্দ মন্ডল। নিত্যানন্দ মন্ডল বলেন — "আমার ছেলে যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। পিতা-মাতার কর্তব্যের প্রতি তার কোন ত্রুটি আমি দেখিনি। সে তার আদর্শ থেকে সরে আসবে না। তার উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। " 

আমাদের সফলভাবে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়া, অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভয়, লজ্জা কাটিয়ে তারাও এই পথে এগিয়ে আসছে। বুঝতে শিখছে, দাহ বা কবর দেওয়ার থেকে মরণোত্তর দেহদান সমাজ কল্যাণের অগ্রগতির দিশারী। 


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929